ছোট্ট একটা স্টেশনে থামল ট্রেনটা। স্টেশনের নাম ‘শশীদল’। খানিকটা গ্রামের মতো, তবে ঠিক গ্রাম নয়, মফস্বল। পাশের চায়ের টঙে হাঁটা ধরলাম সোজা পশ্চিমে। বিস্তর মাঠ, মাঠের বুক চিরে বেয়ে চলেছে মেঠো রাস্তা। রাস্তাটা থেমেছে আশাবাড়ী গ্রামে এসে। সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। দালানকোঠার বালাই নেই, বেশির ভাগ বাড়িই মাটির। গ্রামটির পশ্চিমে আছে আরেকটি গ্রাম। আগরতলার রহিমপুর। মাঝখানে একটা ধানক্ষেতই ভাগ করে দিয়েছে দুই দেশকে। ধানক্ষেতের আইলের ওপর বসানো আছে একটি পিলার। নিয়ম অনুযায়ী আইলের এ-পাশটা বাংলাদেশ আর ও-পাশটা ভারত। কিন্তু এখানে কাঁটাতারটা বসানো হয়েছে পিলার থেকে কমসে কম হাত পঞ্চাশেক ভারতের সীমানার ভেতরে। যার ফলে কাঁটাতারের এপারও ভারত, ওপারও ভারত। পিলার থেকে কাঁটাতার পর্যন্ত জায়গাটায় বসতি গড়ে উঠেছে। গোটা পঁচিশ ঘরের বাস। এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রা অন্যদের চেয়ে কিছুটা আলাদা।
তারা ভারতীয় নাগরিক। জাতীয় পরিচয়পত্রও ভারতের। কিন্তু ভারতে যেতে চাইলে কাঁটাতার পেরোতে হয়। ছেলেমেয়েরা রোজ সকালে কাঁটাতার পেরিয়ে স্কুলে যায়। বিকেলে ফিরে আসে। কাঁটাতার পেরোতে তাদের যে বেগ পেতে হয়, সে তুলনায় বাংলাদেশে আসাটা তাদের জন্য সহজ। একেবারে জলের মতো। শুধু আইলটা পেরোলেই বাংলাদেশ! নো কাঁটাতার! নো ভিসা। আর পাসপোর্টের তো বালাই নেই। আবার বাংলাদেশিদের জন্যও রহিমপুরে যাওয়াটা ওয়ান-টুর ব্যাপার।
পিলারের হাত দশেক ভেতরে (বাংলাদেশ) একটা ছোট্ট মাঠ আছে। সেখানেই রোজ বিকেলে ছেলেরা ফুটবল খেলে। ফুটবল মাঠে ভারত-বাংলাদেশ মিলেমিশে একাকার। বোঝার উপায় নেই কে ভারতীয় আর কে বাংলাদেশি। সবাই বাংলায় কথা বলে। কথার টানও এক। শুধু কাগজে-কলমে জাতীয়তা ভিন্ন।
ওদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ফুটবল খেলেছিলাম আমরা। খেলা শেষে আড্ডা দিলাম ভারতীয় দুই কিশোরের সঙ্গে। সুমন আর অমিত। ক্লাস সিক্সে পড়ে। জানাল, পড়ার বইও বাংলা। তবে নাইনের পর হিন্দি ভার্সন আছে। বাংলা বইয়ে কার কার গল্প কবিতা আছে? ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।’ বাংলাদেশকে আর আলাদা কোনো দেশ ভাবে না তারা। ভাবে এ তো পাশের গ্রাম। জাতীয়তাও আলাদা করতে পারেনি তাদের।
চাইলে আপনিও একবার ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। গ্রামটিতে হয়তো চোখ-ধাঁধানো কোনো দৃশ্য পাবেন না। কিন্তু দুই দেশের মানুষের মেলবন্ধন আপনাকে মুগ্ধ করবে।
কীভাবে যাবেন
ট্রেনে যাওয়াটা বেশ সহজ। কমলাপুর থেকে ছেড়ে যাওয়া চট্টলা কিংবা কর্ণফুলী এক্সপ্রেসে চড়তে পারেন। নামবেন শশীদল স্টেশনে। স্টেশনটি কুমিল্লার জেলায় পড়েছে। স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই যেতে পারবেন রহিমপুরে।
কোথায় থাকবেন
শশীদলে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। চাইলে কুমিল্লায় চলে যেতে পারেন। সিএনজিতে ঘণ্টাখানেক লাগতে পারে। ১৫ কিলোমিটার রাস্তা। কুমিল্লায় থাকার মতো প্রচুর হোটেল পাবেন।
এর মধ্যে আছে কুমিল্লা বার্ড (কোটবাড়ী), হোটেল নূরজাহান (পদুয়ার বাজার), ময়নামতি (শাসনগাছা), কিউ প্যালেস (রেইসকোর্স), আল রফিক, নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে হোটেল অবকাশ, হোটেল সোনালী, হোটেল মেরাজ ও হোটেল আমানিয়ায় থাকতে পারেন।
কোথায় খাবেন
গরীর রেড রফ, গ্রিন ক্যাসেল, সিলভার স্পোন, ক্যাপসিকাম, হোটেল ডায়না, বাঙলা রেস্তোরাঁ, কস্তুরী, হোটেল কাশ্মীরি, পিসি রেস্তোরাঁ, হোটেল রূপসী কিংবা ইউরোকিংয়ে ভালো খাবার পাবেন। এ ছাড়া খেতে পারেন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পদুয়ার বাজারে হোটেল নূরজাহান, চৌদ্দগ্রামের হোটেল হাইওয়ে-ইন, হোটেল অফবিট, ডলি রিসোর্ট, ভিটা ওয়ার্ল্ড, টাইম স্কয়ার, হোটেল তাজমহল এবং আলেখারচরের হোটেল মিয়ামীতে।
সতকর্তা : কাঁটাতার পার হওয়ার চেষ্টা করবেন না কখনো, যা দেখার কাঁটাতারের এ-পাশ থেকেই দেখবেন।