ইসলামের স্বর্ণযুগের পর থেকেই মুসলিম উম্মাহ তাদের গাফলত ও অবহেলার কারণে ধীরে ধীরে তাদের আপন ভূখণ্ডগুলো থেকে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হারাতে শুরু করল। ক্রুসেডার, জায়নিস্ট ও পৌত্তলিক কাফের মুশরিকরা একে একে মুসলিম উম্মাহর ভূখণ্ডগুলো ছিনতাই করে দখলে নিতে থাকল। কাফের-মুশরিকরা তাদের এই কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাকে স্থায়ীত্ব প্রদান করার জন্য এবং শঙ্কামুক্ত রাখার জন্য, আত্মরক্ষা, প্রতিরক্ষা, শাসনক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পর্কে মুসলমানদের মাঝে নানান তাহরীফ ও বিকৃতির অপপ্রচার চালাতে শুরু করল। অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেকি ফানুস দেখিয়ে ধর্ম যার যারা রাষ্ট্র সবার স্লোগান তুলল, ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করল এবং অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলাম ধর্মকেও একটি বৈরাগী ও সেক্যুলার ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অপপ্রয়াস চালাল। বহুলাংশে তারা সফলতাও লাভ করল।
.
ফলে মুসলমানদের মধ্যে, এমনকি দ্বীনের ধারক বাহক আলেমদেরও অধিকাংশ খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও খলিফা নিয়োগের ফরজ কার্যত ভুলেই গেল এবং ইসলাম ধর্মকে সম্পূর্ণই মাদরাসা মসজিদের চার দেয়ালে আবদ্ধ করে ফেললেন। এভাবে জগত ও জাগতিক বিষয়ে ইসলামের কর্তৃত্ব ও ভূমিকা শূন্যে নেমে আসল। সাধারণ তো সাধারণ, আলেমদের মাঝেও বিশাল একটি শ্রেণি তৈরি হল, যারা শত্রুর সুরে সুর মিলিয়ে রাষ্ট্র ও শাসনক্ষমতার সঙ্গে ন্যূনতম সম্পৃক্ত ইসলামী বিষয়গুলোর তাহরিফ ও বিকৃতি সাধন করে সেক্যুলার ও বৈরাগি ইসলামের আধুনিক সংস্করণ; মডারেট ইসলাম প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠল এবং বিনিময়ে তারা বিশ্বনেতাদের আশীর্বাদ লাভে ধন্য হল।
.
তাদের কারো মুখে আমরা শুনতে পাই, ইসলাম গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। কারো মুখে শুনতে পাই, ইসলাম ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম। ইসলাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ধর্ম। যেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে খলীফা নিয়োগ করা তাদের ফরজ ছিল, উম্মাহর কর্ণধার হয়েও তাদের অনেকে সেই রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে নিজেদের ‘বারাআত’ ও সম্পর্কহীনতা প্রমাণ করার জন্য মুখে ফেনা তুলে বলে বেড়াচ্ছেন, ‘আমরা ক্ষমতা চাই না, ক্ষমতার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই; কোনো রকম ছেড়া চাটাইয়ে বসে নিরাপদে আমাদেরকে ‘কালাল্লাহ’ কালাররাসূল’ পড়িয়ে জীবনটা কাটিয়ে যেতে দিন’। আমরা অন্ধ অনুসারীরা ইসলাম বিধ্বংসী এই বক্তব্যগুলোকে ‘আহবার রুহবান’দের যুহুদ ও দুনিয়াবিরাগ হিসেবে সমাদর করে স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছি। কেউ বলছেন, ইসলাম ধর্মে ইসলামী রাষ্ট্রের কোনো ধারণা নেই, এই ধারণা রাজাকার পাকিস্তানের সৃষ্টি! ইসলাম কোনো যমিনের গায়ে কালিমা লেখার জন্য আসেনি! ইসলাম সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত বিষয়!
.
এ যেন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই ভবিষ্যদ্বাণীর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, যাতে তিনি বলেছেন,
لتتبعن سنن من قبلكم شبرا بشبر وذراعا بذراع حتى لو سلكوا جحر ضب لسلكتموه قلنا يا رسول الله اليهود والنصارى قال فمن؟. صحيح البخاري، طبع دار ابن كثير ، اليمامة - بيروت، ص:3/1274
“নিশ্চয় তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের আদর্শ অনুসরণ করবে, বিঘতে বিঘতে, হাতে হাতে। এমনকি তারা যদি গুই সাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তবে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ! ইহুদি নাসারাদের কথা বলছেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওরা নয় তো কারা?”
দ্বীন ও শরীয়তের বিষয়ে তারা কী করেছিল? তার উত্তর দেখুন কোরআনে কারীমে,
فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِيثَاقَهُمْ لَعَنَّاهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَاسِيَةً يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ وَنَسُوا حَظًّا مِمَّا ذُكِّرُوا بِهِ وَلَا تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلَى خَائِنَةٍ مِنْهُمْ إِلَّا قَلِيلًا مِنْهُمْ. المائدة:13
ইবনে কাসির রহ.এর ব্যাখ্যা: “অত:পর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে তাদের উপর যে শাস্তি নেমে আসল, আল্লাহ তার বিবরণ দিচ্ছেন। (তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে তাদেরকে আমি অভিশাপ করেছি) অর্থাৎ হেদায়াতের সত্য ও সঠিক পথ থেকে তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছি। (এবং তাদের অন্তর কঠিন করে দিয়েছি।) ফলে তারা কোনো উপদেশ গ্রহণ করে না। (তারা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করে।) অর্থাৎ তাদের বোধ ও বুঝ শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আল্লাহর আয়াতে তারা অযাচিত হস্তক্ষেপ শুরু করতে এবং আল্লাহর কিতাব বিকৃত করতে শুরু করেছে। (এবং তারা যা উপদিষ্ট হয়েছিল, তার আংশিক ভুলে গিয়েছে।) অর্থাৎ তা থেকে আগ্রহ হারিয়ে তার উপর আমল করা ছেড়ে দিয়েছে। (আপনি সর্বদা তাদের অল্পসংখ্যক ব্যতীত সকলকেই বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখতে পাবেন।)” -সূরা মায়েদা: ১৩
.
প্রিয় পাঠক! মুসলিম সমাজের প্রতি একটু গভীরভাবে তাকিয়ে দেখুন! ইহুদি নাসারাদের এসব অপকর্মের সঙ্গে কত হুবহু মিলে গেছে আজকের মুসলিম সমাজ! তারা যেমন পরিপূর্ণ দ্বীন পালনের ওয়াদা করেও তা ভঙ্গ করেছিল, আমরাও ঠিক তাই করেছি। একেক ব্যক্তি, একেক কাফেলা নিজের পছন্দ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অনুযায়ী দ্বীনের কিছু অংশ ধরেছি, কিছু অংশ ছেড়ে দিয়েছি। ইমামত, খেলাফত, হুদূদ, কেসাস, কিতাল, আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারসহ দ্বীনের কত অসংখ্য বিষয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে আমরা তা পরিত্যাগ করে চলেছি এবং আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও কর্মসূচী থেকেও বিষয়গুলো মুছে ফেলেছি।
.
আজব ব্যাপার হল মুসলিম উম্মাহ আজ শতধা বিভক্ত হলেও এবিষয়গুলো বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রায় সকল কাফেলাই ঐক্যবদ্ধ। ফলে আল্লাহ তাদের অন্তর যেমন কঠিন করে দিয়েছিলেন, আমাদের অন্তরও কঠিন করে দিয়েছেন। যার কারণে আমাদের ছেড়ে দেয়া অংশে যখন আমাদেরকে উপদেশ দেয়া হয়, তা নিজেদের প্রচলন ও অভ্যাসের বাইরে হওয়ায় তা আমরা গ্রহণ করি না, যেমন তারা গ্রহণ করেনি। তারপর আমাদের এই ভ্রষ্ট অবস্থানকে বিশুদ্ধ প্রমাণ করার জন্য দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে আমরা তাহরিফ ও বিকৃতি সাধন করে চলেছি, যেমন তারা করেছে।