ছয়দফাকে বলা হয় বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ছয়দফার মূল শিরোনাম ছিল “ ছয় দফাঃ আমাদের বাঁচার দাবি।”
১৯৪৭ এ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের দ্বিজাতিতত্ত্বের (কার্যত গাঁজা বা মদ খুরী তত্ব) ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়। মুসলিমদের নিয়ে জিন্নাহ পাকিস্তান নামে একট রাষ্ট্র গঠন করেন। যার একভাগ( পশ্চিম) থেকে আরেক (পূর্ব) ভাগের দূরত্বও অনেক।ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুতে তাদের সাথে মিল ছিলনা। পূর্ব পাকিস্তানে সবাই বাঙালি এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গুলোও নিজেদের বাঙালি পরিচয় দিতো ও বাংলায় কথা বলতো। জনসংখ্যা হিসেবে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ । ভাষার দিক থেকে পশ্চিম অংশে ভাষা সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল পান্জাবী ও পশতু ভাষা।
আর সমগ্র পাকিস্তানে বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবুও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখানে তার ওয়াইন ভরা গালে মাতাল কথা বললেন যে পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু। যেখানে তৎকালীন সময়ে উর্দু ভাষী মাত্র ২% জনগণ তাও আবার তা পশ্চিম পাকিস্তানে।যার প্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলন হয়। এভাবে শাসনতন্ত্র, চাকুরী, সেনাবাহিনী,উন্নয়ন প্রভৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানকে চুষে নিয়ে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করতে থাকে আর পশ্চিমা শাসকরা বরাবর আমাদের শোষণ করতে থাকে।
তরুণ মুজিব এটি বিজ্ঞের মত পর্যবেক্ষণ করেছেন।এজন্য তাকে পাকিস্তান আমলে ১৩ বছর জেল খাটতে হয়েছে। তার সিনিয়র নেতারা এ বিষয়ে চুপ থাকলেও তিনি সোচ্চার ছিলেন বাঙালির অধিকার নিয়ে।
এর প্রেক্ষিতে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য দাবী তুলেন।২৩শে ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন।
ছয়দফার দাবী গুলো নিম্নরূপ;
প্রস্তাব - ১ : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারী ধরনের। আইন পরিষদের (Legislatures) ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারনের সরাসরি ভোটে।
প্রস্তাব - ২ : কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু'টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
প্রস্তাব - ৩ : মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু'টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু'টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা,
(খ)বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
প্রস্তাব - ৪ : রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
প্রস্তাব - ৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
প্রস্তাব - ৬ : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
উপরোক্ত দফা গুলোতে আলোকপাত করলেই বোঝা যায় এটি কার্যত সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি কর্মসূচি। কিন্তু যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ২% উর্দু ভাষীর ভিত্তিতে অযৌক্তিক ভাষা সংস্কার করতে চেয়েছেন তিনি কি কখনো এই দাবী গুলো মানবেন।
মানেনি,যার প্রেক্ষিতে আন্দোলন,কারাবরণ,অভ্যুথ্থান হতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় লাভ করেন।তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায় তবুও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টের ক্ষমতা রহিত করে তাদের বিজয়কে মেনে নেননি। আলোচনার নামে টালবাহানা করে সৈন্যসমাবেশ ঘটিয়ে ২৫ শে মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা অপারেশন সার্চলাইট ও বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারে অপারেশন বিগ বার্ড হান্ট চালায়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখিত আকারে দেন যা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান পাঠ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন এবং পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হুকুম দেন।
এরপর বাংলাদেশের সরকার গঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। আমাদের সরকার, ভূমি ও জনগণ সব ছিল শুধু সার্বভৌমত্ব পাকিস্তানের হাতে ছিল। সেটি পেতে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ হয়। বাংলাদেশ সরকার দেশের জনগণকে বহির্বিশ্বের সাহায্য নিয়ে সহযোগিতা,যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরী ও তার সেনাবাহিনী এই যুদ্ধ করতে রসদ সামগ্রী সরবরাহ করেন । ভারত আমাদের প্রথম স্বীকৃতি দিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী সাথে কোয়ালিশন গঠন করে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়।আমরা সার্বভৌমত্ব পাই।
এতটুকু বলে দেয়ার কারণ হচ্ছে ছয়দফা দাবী না মানা কারণে বাঙালি জনগণ আর পাকিস্তানের শাসকে শাসনের চোখে না দেগে শোষণের চোখে দেখা শুরু করে। যার চুড়ান্ত রুপ ৭১ এ মানুষ দেখেছে। তাই হয় দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ তথা অধিকার প্রতিষ্ঠার সনদ বলা।
ধন্যবাদ