কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড়ে (চব্বিশ পরগনা জেলায় এবং কলকাতা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরপূর্ব দিকে একদা ভাগীরথী নদীর অন্যতম প্রবাহ বিদ্যাধরী নদীর কূল ঘেঁষে এর অবস্থান।) প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এই অঞ্চলটি বিগত দুই হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে জনবসতিপূর্ণ। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্য (১৪৯৫ খ্রি.), মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কণ চণ্ডী (১৫৯৪-১৬০৬ খ্রি.), সৈয়দ আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৫–৫২ খ্রি.), কৃষ্ণরাম দাসের কালিকামঙ্গল (১৬৭৬–৭৭ খ্রি.), সনাতন ঘোষালের ভাষা-ভাগবত (১৬৭৯–৮০ খ্রি.) ও কৃষ্ণদাসের নারদপুরাণ (১৬৯২ খ্রি.)। ১৫৮২ সালে রাজা টোডরমলের নির্দেশে সমগ্র বাংলা সুবা (প্রদেশ) জরিপ করে ওয়ালিশ-ই-জমা তুমার নামে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি (১৫৯০ খ্রি.) গ্রন্থে উদ্ধৃত এই তালিকাটিতে "কলিকাতা" গ্রামটির উল্লেখ রয়েছে।এছাড়াও গোলাম হোসেন সেলিম রচিত রিয়াজ-উস-সালাতিন (১৭৮৬ খ্রি.) নামক একটি ফার্সি গ্রন্থেও "কলিকাতা" গ্রামের উল্লেখ রয়েছে।
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলায় পর্তুগিজদের যাতায়াত শুরু হয়। সেযুগে টালির নালা ( মারহাট্টা ডিচ) বা আদিগঙ্গা ছিল সমুদ্রে যাতায়াতের পথ। সমুদ্রগামী বড়ো বড়ো জাহাজগুলি এখন যেখানে গার্ডেনরিচ, সেই অঞ্চলে নোঙর ফেলত। কেবল মাত্র দেশি ছোটো নৌকাগুলিই হুগলি নদীর আরো উজানের দিকে চলাচল করত। সরস্বতী নদী ছিল এই সময়কার আরও একটি জলপথ। এই নদী ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে শুকিয়ে যেতে শুরু করে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে যে-তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল, গোবিন্দপুর ছিল তার অন্যতম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অপর দুটি গ্রাম ছিল সুতানুটি ও ডিহি কলিকাতা। কলকাতা মহানগরীর প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটি ও ডিহি কলিকাতা তাদের নিজস্ব পরিচিতি হারায়; এবং নতুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের সময় গোবিন্দপুর গ্রামটি ধ্বংস করে ফেলা হয়।
গোবিন্দপুর গ্রামের নামকরণ প্রসঙ্গে আরও একটি গল্প প্রচলিত আছে: গোবিন্দ দত্ত নামে এক ব্যক্তি এই অঞ্চলের উপর দিয়ে তীর্থে যাচ্ছিলেন। দেবী কালী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে আদেশ করেন নদীর তীরবর্তী পরিত্যক্ত ভূভাগ খনন করতে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী কাজ করে তিনি মাটির তলা থেকে প্রচুর ধনসম্পত্তি উদ্ধার করেন। গোবিন্দ দত্ত এখানেই থেকে যান এবং তাঁর নামানুসারেই গ্রামের নামকরণ হয় গোবিন্দপুর।
জব চার্নক সুতানুটির নিরাপদ অবস্থানের জন্য সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। সেই যুগে সুতানুটি পশ্চিমে হুগলি নদী এবং পূর্বে ও দক্ষিণে দুর্গম জলাভূমির দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কেবলমাত্র উত্তর-পূর্ব অংশে প্রহরার প্রয়োজন হত।
সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা ও গোবিন্দপুর ছিল মুঘল সম্রাটের খাসমহল অর্থাৎ সম্রাটের নিজস্ব জায়গির বা ভূসম্পত্তি। এই অঞ্চলের জমিদারির দায়িত্ব ছিল বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের উপর। ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর জব চার্নকের উত্তরসূরি তথা জামাতা চার্লস আয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের থেকে এই তিনটি গ্রামের জমিদারির অধিকার কিনে নেন। এরপরই কলকাতা মহানগর দ্রুত বিকাশ লাভ করে। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়মিত এই অঞ্চলের রাজস্ব মুঘল সম্রাটকে দিয়ে এসেছিল।
বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতায় দুর্গপ্রতিষ্ঠা ও সামরিক আয়োজনে অসন্তুষ্ট হয়ে ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ ও অধিকার করে নেন। এই সময় ইংরেজরাই গোবিন্দপুরে অগ্নিসংযোগ করে গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়। নদীর চল্লিশ মাইল ভাটিতে ফলতায় তারা সাময়িকভাবে আশ্রয় নেয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পরই তারা কলকাতার অধিকার পুনরায় ফিরে পেয়েছিল।
কলকাতায় ফিরে এসে ব্রিটিশরা যে কাজটি করেছিল তা হল ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পুনর্নির্মাণ। ১৭৫৮ সালে এই কাজ শুরু হয়; শেষ হয় ১৭৭৩ সালে। দুর্গনির্মাণের জন্য বেছে নেওয়া হয় ‘বর্ধিষ্ণু’ গোবিন্দপুর গ্রামের কেন্দ্রীয় অঞ্চলটিকে। ‘ক্ষতিপূরণ অর্থে’র একাংশ খরচ করা হয় দুর্গনির্মাণের জন্য জমিদাতাদের তালতলা, কুমারটুলি ও শোভাবাজার অঞ্চলে জমিদান করার জন্য।
সুতানুটি (পুরনো ইংরেজি বানানে Suttanuttee) । খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সুতানুটি ও তার পার্শ্ববর্তী দুটি গ্রাম কলিকাতা ও গোবিন্দপুরকে নিয়ে আধুনিক কলকাতা শহরটি গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক জোব চার্নক (ইংরেজি ঐতিহাসিকেরা যাঁকে "কলকাতার জনক" আখ্যা দিয়েছিলেন) এই গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
বর্তমান উত্তর কলকাতার বাগবাজার, শ্যামবাজার ও তার আশেপাশের এলাকাগুলিই অতীতে সুতানুটি গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। গোবিন্দপুর, সুতানুটি, ও ডিহি কলকাতা (এ ছাড়াও কালীঘাট ও চিৎপুর) নিয়ে তৈরি হয় অধুনা কলকাতা ও সালকিয়া ও বেতড় (হাওড়ার শিবপুরের কাছে) অঞ্চল নিয়ে তৈরি হয় হাওড়া ।
সুতানুটি ও বেতড় দুটি গ্রামই ছিল গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। সপ্তদশ শতাব্দীতে কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলে যখন নগরায়ণ শুরু হয়, তখন এই দুটি গ্রাম যথাক্রমে কলকাতা ও হাওড়া মহানগরীর মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।