১৯১৪ সালের ২৮শে জুন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। হত্যাকারী ছিলেন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় নাগরিক, কিন্ত জাতিতে বসনীয় সার্ব। সে সময় বসনিয়া ছিলো সাম্রাজ্যটির অংশ। গাভরিলো প্রিন্সিপ নামের ছাত্রটি ছিলেন 'তরুণ বসনিয়া' দলের সদস্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরী শাসন থেকে মুক্তি যাদের লক্ষ্য। ঘটনাটি ঘটে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য সার্বিয়াকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানায়।
সে যুগে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ছিলো গোপনীয়তায় ভরা ও জটিল । ফ্রান্সের ঐতিহাসিক শত্রুতার কারণে ব্রিটেন প্রথমদিকে জার্মানীর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলো। কিন্ত জার্মানী ব্রিটেনের সাথে নৌ- প্রযুক্তিতে পাল্লা দিতে শুরু করায় সম্পর্কটি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে।
ফ্র্যাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর থেকে জার্মান ও ফরাসিদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। ফরাসিরা তাই রাশিয়ার সাথে মৈত্রী করে। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী রাশিয়াকে হুমকি হিসেবে দেখতো, তাই তারা জার্মানীর সাথে মৈত্রী চুক্তি করে।
সার্বিয়ার উত্থানের সাথে সাথে স্লাভ জাতীয়তাবাদ জোরদার হয়ে ওঠে। সুযোগ পেয়ে এবার অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী সার্বিয়াকে কোণঠাসা করে ফেলে। সার্বিয়ার মিত্র রাশিয়া, সে জোরে সার্বিয়া হুমকি অগ্রাহ্য করবার সাহস দেখায় ও সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। বিভিন্ন মৈত্রী চুক্তি, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন পর্যায়ে সত্যের বিভিন্ন বিকৃতি রাষ্ট্রনায়কদের যুদ্ধের সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়।
২৮ জুলাই ১৯১৪ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী সার্বিয়ার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরদিন রাশিয়া সৈন্য সমাবেশের মাধ্যমে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে জার্মানীও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। এদিকে সার্বিয়ার সমর্থনে ফ্রান্স সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। যুবরাজের হত্যার পর, জার্মানীর হিসাবে ছিল যে, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে একটি সংক্ষিপ্ত, আঞ্চলিক যুদ্ধে বিজয়ের সম্ভাবনা আছে। তাই তারা অস্ট্রিয়াকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সার্বিয়ায় হামলা করার অনুমুতি দিয়ে দেয়। যা হয় বিরাট ভুল!
জার্মানী অস্ট্রিয়াকে নজিরবিহীন সমর্থন দেয়ায় ভবিষ্যৎ জার্মান শক্তি'র সম্ভাবনায় আতঙ্কিত ফ্রান্স এবং রাশিয়ার তরফ থেকে অনাকাঙ্খিত শত্রুতা ডেকে আনে! রাশিয়া এবং ফ্রান্স সাথে সাথে যুদ্ধে যোগ দিলেও জার্মানী তাদের ভালই মোকাবেলা করছিল, কিন্তু ব্রিটেনের চোখে রাশিয়া এবং ফ্রান্সের তুলনায় একটি নতুন ও শক্তিশালী জার্মানী ছিল বড় হুমকী তাই তারা পূর্বের চুক্তি অনুযায়ী ও নিজেদের ক্ষমতার সুরক্ষিত করার জন্যই জার্মানীর বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয়। ব্রিটেনের মত পরাশক্তির আগমন জার্মানীর জন্য ব্যাপক হুমকী হয়ে দাড়ায়! আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মাঝেই রাশিয়া পরাজিত হয়ে যুদ্ধত্যাগ করে। ব্যাপক সৈন্য ও সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি ও কম্যুনিস্ট প্রোপাগান্ডাই সম্রাটের পতন ও রাশান পরাজয় নিশ্চিত করে! ইতোমধ্যেই ৩ বছর ধরে চলা যুদ্ধে এবং শীতকালে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতির শিকার জার্মান সেনাবাহিনী অদুরদর্শীতার পরিচয় দেয় আমেরিকান জাহাজে আক্রমণ করে! জার্মান নৌ-বাহিনীর আক্রমণ ঘুমন্ত দৈত্য যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে ডেকে এনে চুড়ান্ত জার্মান পরাজয় নিশ্চিত করে! ( এমন স্ট্র্যাটেজিক ভুল জার্মানদের দ্বারাই সম্ভব তা আবারো প্রমানিত হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধে )
এছাড়া শিল্পন্নোয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে নব্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা জার্মানীর উত্থান ফ্রান্স, ব্রিটেনের সাম্রাজ্যের জন্য নিশ্চিত হুমকি ছিল এবং এটা ঠেকানোর জন্যই ফ্রান্স-রাশিয়া-ব্রিটেন এবং সবশেষে যুক্তরাষ্ট্র একজোট হয়! এবং ৪ বছর ধরে চলা ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি নিশ্চিতের পর হাবসবুর্গ (অস্ট্রিয়ান) অটোমান (তুর্কিশ) এবং রোমানভ (রাশিয়ান) সাম্রাজ্যের মত ৩ টা শতাব্দী প্রাচীন একসময়ের প্রবল আধিপত্য বিস্তারকারী সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিতকারী পরজয় ভাগ্যে জুটে! এবং নিজেদের আড়াল করার নীতি থেকে সরে এসে যুদ্ধের শেষ দিকে যোগ দিয়েই মুল নায়কের আসনে বসে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র! এবং প্রেসিডেন্ট উইলসনের নেতৃত্ব শুরু হয় দুনিয়ায় নতুন ধরনের রাজনীতি!কিন্তু যুদ্ধের পর পর সবাই যখন ভাবছিল যে এমন মানবসৃষ্ঠ দুর্যোগের আর পূনরাবৃত্তি ঘটবে না তখনই তৎকালীন বিজয়ী ও পরাজিত শক্তিগুলো এমন সব কান্ড করতে থাকে যা সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ এবং দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী করছিল!!!!
তথ্য সুত্রঃ উইকিপিডিয়া