“ভগবান” শব্দটি খুব প্রচলিত একটি শব্দ বিশেষ করে হিন্দু আর বৌদ্ধ সমাজে। “ভগবান” শব্দটির সুনির্দিষ্ট ও সর্বসম্মত বা সর্বজন গ্রাহ্য অর্থ নেই। একেকজন লেখক, গবেষক, তাত্ত্বিক, ধর্মগুরু কিংবা ভাষাবিধ এই শব্দটির একেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আসুন দেখি এই “ভগবান” শব্দের অর্থ কে কিভাবে ব্যাখ্যা করে থাকেন সাধারণত- ১। প্রখ্যাত লৌকিক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর তার ‘সত্যের সন্ধানে’(আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র-০১) নামক বইতে “ভগবান” শব্দের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- ভগবান শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। এটি গঠিত হয়েছে ‘ভগ’+‘বান’। ‘ভগ’ অর্থ স্ত্রীর যৌনি আর ’বান’ অর্থ চিহ্ন। সুতরাং ‘ভগবান’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘যৌনিচিহ্ন’। এর পিছনে একটা হিন্দু ধর্মের উপাখ্যান আছে। উপাখ্যানটি এরকম- দেবরাজ ইন্দ্রর গুরু হলেন মহামুনি গৌতম ঋষি। একদা গৌতম ঋষির অনুপস্থিতিতে দেবরাজ ইন্দ্র তার গুরুপত্নী অহল্যাকে স্নান শেষে ভেজা কাপড়ে দেখে মনে কাম বাসনার উদ্রেক হয় এবং তা চরিতার্থ করার জন্য তিনি গুরু মহামুনি গৌতমের রূপ ধারণ করে তার স্বীয় গুরুপত্মী অহল্যার সাথে মিলিত হন। সতী নারী অহল্যার সতীত্ব হরণ করার পাপে পুনরায় ইন্দ্রের আসল রূপ প্রকাশিত হয় এবং এটা গুরু গৌতম ঋষি জানতে পারেন। ফলে গৌতম ঋষি ক্ষিপ্ত হয়ে ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন সমস্ত শরীরে যেন স্ত্রী জননাঙ্গ বা যৌনি দেখা দেয়। এতে ইন্দ্রের সমস্ত শরীর জুরে যৌনাঙ্গ দেখা দেয়ায় দেবরাজ ইন্দ্রের জন্য সেটা ভীষণ লজ্জার কারণ হলে তিনি তার গুরু গৌতমের পদতলে প্রণামপূর্বক ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। কিন্তু ঋষির মুখের বাণী অব্যর্থ। দেয়া অভিশাপ ফিরানো যায় না। তবু নিজের দোষ স্বীকারপূর্বক সকাতরে ক্ষমা চান বিধায় গৌতম ঋষি অভিশাপটা হালকা করনপূর্বক বলেন ইন্দ্রের শরীরে পরিপূর্ণ স্ত্রী জননাঙ্গ থাকবে না, কেবল চিহ্ন আকারে থাকবে। একারণে ইন্দ্রের নাম হয়ে যায় ‘‘ভগবান”। দূর থেকে চিহ্নগুলো দেখতে চোখের মতও লাগত বলে সহস্রলোচন(লোচন অর্থ চোখ) নামে ইন্দ্রের আরেকটি নাম হয়। [এখানে উল্লেখ্য আরজ আলী মাতুব্বর মহোদয় কেবল এটুকু অর্থ(নেগেটিভ) নিয়েই ক্ষান্ত হলেন। অনেকটা ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ তার “অলৌকিক নয় লৌকিক-০৫” গ্রন্থে “উং মনি পদ্মে হুম”(পরে এটা নিয়ে লেখার ইচ্ছে আছে) এই শ্লোকটির ব্যাখ্যা দেয়ার মতই। দু‘জন লেখকই কেবল নেগেটিভ অর্থ ব্যাখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন। তাদের লেখাগুলো পড়ে অনেকেই এটাই ‘‘শেষ কথা’’ হিসেবে ধরে নিয়ে থেমে থাকেন।] "গুরুতল্পে ভগঃ কার্য্যঃ সুরাপানে সুরাধ্বজঃ । স্তেয়ে চ শ্বপদং কার্য্যঃং ব্রক্ষ্মহন্যশিরা পুমান্ ।। অর্থঃ গুরুপত্নী গমনে অপরাধীর কপালে স্ত্রী যোনী চিহ্ন, সুরাপানে সুরাপাত্র চিহ্ন, চৌর্যে কুকুর চিহ্ন, ব্রহ্ম হত্যায় কবন্ধ চিহ্ন একে দিতে হয়।" সূত্র: মনুসংহিতা, অনুবাদ- সুরেশচন্দ্রবন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যায়-৯ম, স্লোক-২৩৭, পৃষ্ঠা নং-২৭৪। হিন্দু ধর্মের অন্য আরেকটি উপাখ্যান মতে - শিবের পত্নী দুর্গাদেবী মানবকূলে জন্ম নিলে তার নাম রাখা হয় ভগবতী। বিবাহের শর্ত মোতাবেক বা অন্যকোন কারণে স্ত্রী দুর্গার নাম ‘‘ভগবতী’’ এর পুরুষবাচক শব্দ হিসেবে শিবের নাম হয় ‘‘ভগবান”। ২। ‘ভগবান' শব্দের অর্থ একটি সরল সংজ্ঞা হচ্ছেঃ 'জন্মদাস্যযতঃ' - "যাঁর থেকে সমস্ত প্রকাশিত হয়"(ভাঃ ১/১/১)। 'ভগবান' শব্দটি সংস্কৃত, এবং এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি- "(১) সমগ্রঐশ্বর্য(ধনসম্পদ), (২) সমগ্র বীর্য(শক্তিমত্তা), (৩) সমগ্র যশ, (৪) সমগ্র শ্রী(সৌন্দর্য, রূপবত্তা), (৫) সমগ্র জ্ঞান ও (৬) সমগ্র বৈরাগ্য যাঁর মধ্যে পূর্ণ-রূপে বর্তমান, সেই পরম পুরুষ হচ্ছেন ভগবান।" এখানে 'ভগ' শব্দের অর্থ ছয়টি ঐশ্বর্য(ষড়ৈশ্বর্য) এবং 'বান' শব্দের অর্থ যুক্ত বা সমন্বিত। যেমন জ্ঞানবান অর্থ জ্ঞান-সমন্বিত, ধনবান শব্দের অর্থ ধন-সমন্বিত, তেমনি ভগবান(পরমশ্বের ভগবান) শব্দের অর্থ উক্ত ছয়টি ঐশ্বর্য(ষড়ৈশ্বর্য) যুক্ত পরমেশ্বর প্রভু। বিষ্ণুপুরাণ-৬.৫.৭৯ মতে “যিনি পরম ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য গুণযুক্তা তিনিই ভগবান”এখানে নির্গুণা-পরাব্রহ্মা, হিরণ্যগর্ভা, পরমাত্মা, ভগবান এছাড়া সচ্চিদানন্দ, পরমপুরুষ, ঈশ্বরের গুণ কে মানব কল্যাণের উপর ভিত্তি করে ৬ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এছাড়া সংস্কৃত অভিধানে “ভগবান” এর “ভগ” শব্দের অর্থ – Fortune, Wealthy, Prosperity, Blessed. যেখানে –Fortune= শ্রী, Wealthy= ঐশ্বর্য, Prosperity= বীর্য+যশ Blessed= জ্ঞান+বৈরাগ্য অথ্যাৎ তিনিই ভগবান যিনি মানব কল্যাণের জন্য – শ্রী দাতা, সকল ঐশ্বর্য দাতা, সকল প্রকার জ্ঞান দাতা, সকল প্রকার বীর্য ও যশ দাতা, যিনি সর্বদা ভোগ বিষয়ে অনাসক্ত(বৈরাগ্য) তিনিই ভগবান । ৩। এবার আসুন জেনে নেয়া যাক বৌদ্ধধর্মে ‘‘ভগবান’’ বুদ্ধ বলতে কী বোঝানো হয়েছে। আমরা যারা “বুদ্ধ বন্দনা” করি তারা একটু মনযোগ দিয়ে বন্দনাটি খেয়াল করে দেখবেন, উক্ত বন্দনায় নয়টি শব্দ ব্যবহার হয়েছে, যাঁর প্রত্যেকটার অর্থ গুণবাচক। শব্দ সমুহ হলোঃ- ১. অরহং(অরহত) ২. সম্মাসম্বুদ্ধ (সম্যক সম্বুদ্ধ) ৩. বিজ্জাচরন সম্মন্নো (বিদ্যাচরণ সম্পন্ন) ৪. সুগতো(সুগত/সুগতিপ্রাপ্ত) ৫. লোকবিধু(লোকজ্ঞ) ৬. অনুত্তরো পরিসদম্ম সারথি(অনুত্তর পুরুষদমনকারী সারথি) ৭. সত্থা দেব মনুস্সানং (দেব মানবের শাস্তা) ৮. বুদ্ধো(বুদ্ধ) ৯. ভগবা(ভগবান)। এখানে ৯নং শব্দটি দেখুন “ভগবা” যার অর্থ ভগবান। ইহা অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ উপাধি। প্রাণী জগতের মধ্যে যিনি সবার শ্রেষ্ঠ তিনিই এই উপাধি লাভ করার যোগ্য। সমস্ত সত্ত্বার শ্রেষ্ঠ ও উত্তম এজন্য তিনি “ভগবান”। সমগ্র জীবজগতে যিনি জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় ঐশ্বর্যবান বা ভাগ্যবান তিনিই ভগবান। এখানে ভগবা শব্দটি এসেছে ‘ভগ’ শব্দ থেকে যার অর্থ ছিন্ন করা বা ধ্বংস করা আর ‘‘বান” অর্থ “বন্ধন”। সুতরাং “ভগবান” অর্থ যিনি বন্ধন ছিন্ন বা ধ্বংস করেছেন। পালি ভাষায় পাওয়া যায় “ভগগরাগো, ভগগদোসো ভগগমোহো, অনাসবো, ভগগসস পাপকাধম্মা ভগবা তেন বুচ্চতি” । অর্থাৎ যার রাগ, দ্বেষ এবং মোহ ভগ্ন(ধ্বংস) হয়েছে, যিনি অনাসক্ত এবং সকল পাপ কর্মকে বিনাশ করেছেন। তিনিই ‘‘ভগবান’’(The Blessed One) বলে কথিত হন। প্রাণী জগতে জন্ম নিয়ে(মানুষ হিসেবে) উক্ত বন্ধন(আসক্তি) ছিন্ন বা ধ্বংস করেন বলেই প্রাণীকূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হন। তাই ভগবা বা ভগবান। হিন্দু ধর্ম থেকে ভগবান শব্দটি বৌদ্ধ ধর্মে এসেছে কিনা সে ব্যাপারে পরিষ্কার করে কিছু বলা না গেলেও এটা বলা যায় যে দুই ক্ষেত্রে শব্দটির প্রয়োগ এবং ব্যাঞ্জনার্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। হিন্দু ধর্মে ভগবান অর্থে সৃষ্টিকর্তাকে বুঝানো হয়। অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মে ভগবান অর্থ বন্ধনমুক্ত(লোভ, মোহ, দ্বেষ, রাগ, আসক্তি বা তৃষ্ণা বন্ধন) পরিপূর্ণ আলোকিত সত্ত্বাকে বুঝানো হয়। উপরন্তু বৌদ্ধ ধর্মে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। "অত্তাহি অত্থানো নাথ কোহি নাথ পারোসিয়া,... " অর্থাৎ মানুষ স্বয়ং নিজেই নিজের ত্রাণকর্তা, কেউ কারও নাথ বা ত্রানকর্তা নন। "সব্ব সত্ত্বা কম্মসখা" - সকল সত্ত্বগণ কর্মের অধীন, কর্মই তাদের বন্ধু। .................................... তথ্যসূত্র: ১। আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র- ০১ ২।
https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%85%E0%A6%B9%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE ৩।
https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=768656939852776&id=682664665118671 ৪।
http://www.somewhereinblog.net/blog/habib123best/29960955 ৫।
https://sanatandharmatattva.wordpress.com/tag/%E2%80%8E%E0%A6%AD%E0%A6%97%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E2%80%AC-%E0%A6%B6%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5/ ৬।
https://www.istishon.com/?q=node/20197 ৭।
https://www.facebook.com/permalink.php?id=142741855891456&story_fbid=245480862284221 ৮।
http://www.anupamasite.com/i_krishna.php ৯।
http://sonatonlove.blogspot.com/2012/08/blog-post_5063.html ১০।
http://www.arojalimatubbar.com/2015/12/bhogobaner-mrittu.html ১১। বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ ১২।
https://en.wikipedia.org/wiki/Bhaga