যাকাত কী ও কেন?
যাকাত ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের অন্যতম। কোন ব্যাক্তি যখন কালেমা পড়ে ইসলামের সীমার মধ্যে দাখিল হয়, তখন থেকেই ইসলামের যাবতীয় বিধি-নির্দেশ মেনে চলা তার জন্য অপরিহার্য।
যাকাত আদায় করা সচ্ছল মুসলমানের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ। কোন মুসলমানের স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে এ নির্দেশ অমান্য করার অর্থই হলো আল্লাহ ও ঁতার রাসূলের সাথে মুনাফেকী করা।
যাকাত শব্দের অর্থ পবিত্র করা, পরিশুদ্ধ করা বা প্রবৃদ্ধি দান করা। শরীয়তের ভাষায়, সুনির্ধারিত সম্পদ সুনির্ধরিত শর্তে তার হকদারকে অর্পণ করা। এক কথায় কোন মুসলমান আল্লাহ নির্ধরিত (নিসাব) পরিমান সম্পদের মালিক হলে এবং তা এক বছর পর্যন্ত তার কাছে থাকলে তার নির্ধারিত পরিমান অংশ হকদারের কাছে পৌছে দেয়াকে যাকাত বলা হয়। সুনির্ধারিত অংশটি শরীয়ত সম্মতভাবে আদায় না করলে গোটা সম্পদই মুমিনের জন্য হারাম হয়ে যায়।
যাকাত দাতা হওয়ার শত্যবলি:
যিনি যাকাত দেবেন তার মধ্যে নিন্মলিখিত বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে-
1. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া: নাবালেগের উপর যাকাত ফরজ হয় না।
2. যাকাত দেয়ার জন্য নিয়ত করা: নিয়ত না করে নিজের সকল সম্পদ সদকা করলেও যাকাত হবে না।
3. বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন হওয়া: পাগলে জন্য যাকাত ফরজ নয়।
যাকাতের অর্থ ব্যায়ের শরিয়ত নির্ধারিত 8টি খাত:
যাকাত নিজ হচ্ছেমত যাকে-তাকে দিলে আদায় হবে না। আল্লাহ তায়ালা যাকাতের 8টি খাত উল্লেখ করেছেন।
1. ফকির: ফকির এমন মজুর ও শ্রমজীবীকে বলা হয়, যে শারীরিক ও মানসিকভাবে কর্মক্ষম হওয়া সত্ত্বেও প্রতিকূল অবস্থার কারণে বেকার ও উপার্জনহীন হয়ে পড়েছে। যে সব অভাবগ্রস্থ মেহনতি লোক কোন জালিমের জুলুম হতে আত্মরক্ষার জন্যে জন্মভূমি ছেড়ে এসেছেন বা আসতে বাধ্য হয়েছেন তাদেরকেও ফকির বলা যেতে পারে।
2. মিসকিন: দৈহিক অক্ষমতা যাকে নিস্কর্মা ও উপার্জণহীন করে দিয়েছে তাকে মিসকিন বলে। বার্ধক্য, রোগ, অক্ষমতা, পঙ্গুত্ব যাকে উপার্জনের সুযোগ হতে বঞ্চিত করেছে অথবা যে ব্যাক্তি উপার্জন করতে পারে কিন্তু তা দ্্বারা তার প্রকৃত পয়োজন মোটেই পূর্ণ হয় না; অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্থ, পঙ্গু, খাদ্য-বস্ত্র ও আশ্রয়হীন শিশু ইত্যাদি সকলকেই মিসকিন বলা হয়।
3. যাকাত বিভাগের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা: যাকাত আদায় এবং তা সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্টভাবে বন্টন করার কাজে যারা সার্বক্ষনিক নিযুক্ত থাকবে এবং যারা অন্য কোনভাবে জীবিকা নির্বাহের ব্যাবস্থা করতে অক্ষম, সেসব কর্মচারীর নূন্যতম প্রয়োজন পূরণার্থে আদায়কৃত যাকাত থেকে তাদের বেতন -ভাতা দেয়া হবে।
4. নও মুসলিমদের মন আকৃষ্ট করা: অমুসলিমদের অত্যাচার থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষার জন্যে যাকাতের সম্পদ ব্যায় করা যাবে। ইসলাম প্রচারের কাজ কোথাও প্রতিরোধের সন্মুখীন হলে সে ক্ষেত্রে যাকাতের অর্থ ব্যায় করা যাবে। সংগতিহীন নও মুসলিমকেও স্বনির্ভর করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যায় হতে পারে।
5. ক্রীতদাস মুক্তি: যেসব দেশে দাস প্রথা চালু আছে এবং মুসলমানদেরকে দাস বানিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে দাসদেরকে অর্থ দিয়ে মুক্ত করার কাজে যাকাতের সম্পদ ব্যায় করা যাবে।
6. রীণমুক্তি: প্রথমত, যারা নিজেদের দৈনিন্দিন প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে ঋনগ্রস্থ হয়েছে এবং সে ঋন পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছে, তাদেরকে যাকাতের সম্পদ হতে সাহায্য করা যাবে। দ্বিতীয়ত, যারা মুসলমানদের সামষ্টিক কল্যাণ ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ঋন গ্রহণ করে, তাদের সে ঋন শোধ করার জন্য যাকাত দেয়া যাবে।
যাদের বাড়ি-ঘড় আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেছে, বন্যা-প্লাবনে মাল-আসবাব ভেসে গেছে, তাদের পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের জণ্যে যাকাতের সম্পদ দেয়া যাবে।
7. ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ব্যাবস্থা: যাকাতের ৭ম খাত হলো 'ফি সাবীলি্লাহ' (আল্লাহর পথে)। ইসলামী চিন্তাবিদগণের সম্মিলিত মত হলো:
ক. আল্লাহ নির্দেশিত পথে প্রতিটি জনকল্যাণকর কাজে, দ্্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যত কাজ কার সম্ভব সে সব ক্ষেত্রেই এ অর্থ ব্যায় করা যাবে। (ইসলামের অর্থনীতি- আল্লামা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, পৃ-277)
খ. 'ফী সাবী লিল্লাহ'র ব্যাবহারিক অর্থ জিহাদ ছাড়া আর কিছু নয়। কোরানের যেখানেই সাবী লিল্লাহ কথাটির উল্লেখ রয়েছে সেখানেই তার অর্থ হিসেবে জিহাদকে বোঝানো হয়েছে; মাত্র দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া। (আল্লামা ইবনে কুদামা: ইসলামের যাকাত বিধান- 2য় খন্ড, পৃ- 37)
গ. ইসলামী জনকল্যাণমূলক সংস্থাসমূহকে যাকাত দেয়া জায়েজ। (মুফতি শায়খ হোসাইন মাখলুক, ইলামের যাকাত বিধান- 2য় খন্ড, পৃ- 147)
8. মুসাফির: যাকাতের 8ম খাত হলো 'ইবনুস সাবীল' (নি:স্ব পথিকেদের জন্যে)। সৎ উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে যারা পথিমধ্যে নি:সম্বল হয়ে পড়েছে, তাদেরকে যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে।