নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুলসহ সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন একটি আলোচিত নাম। লোমহর্ষক ঘটনার জন্ম দিয়ে পালিয়ে যান প্রতিবেশি দেশ ভারতে।
১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের সহায়তায় আবারো দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সাত খুনের মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রধান আসামী নুর হোসেন।
শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের আদালতে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত। বর্তমানে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে নুর হোসেন।
একটি ট্রাকের হেলপার দিয়ে শুরু হয় নুর হোসেনের কর্মজীবন। সেখান থেকেই এক সময় অপরাধ সাম্রাজ্যে জড়িয়ে হয়ে যান কোটিপতি।
টাকার জোরে ধীরে ধীরে স্থানীয় রাজনৈতিক শীর্ষ নেতা, আইনশৃংখলা বাহিনীর শীর্ষ কমকর্তা, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেন তিনি। এ সুবাধে জেলাব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করে বনে যান মাফিয়া সাম্রাজ্যের ডন।
কে এই নূর হোসেন : সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল টেকপাড়া এলাকার মৃত হাজী বদর উদ্দিনের ছেলে নূর হোসেন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে নূর হোসেন তৃতীয়।
যেভাবে উত্থান : নূর হোসেন ১৯৮৬ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় ইকবাল গ্রুপ অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রীজের ট্রাকের হেলপার ছিলেন তিনি। ট্রাক মালিক ছিলেন মৃত আ. মান্নান কন্ট্রাক্টার।
হেলপার হিসেবে কাজে যোগদান করার কিছুদিন পরই ট্রাকের নতুন চাকা খোলে চুরি করে বিক্রি করে দেওয়ার অপরাধে তাকে পিটানো হয়। চুরি করে ট্রাকের চাকা বিক্রি করা নূর হোসেনের প্রথম অপকর্ম।
শিল্পপতি মুহাম্মদ আলীর হাত ধরে ১৯৮৫ সালে যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৮৮ সালের দিকে শিমরাইলে আন্তঃজেলা ট্রাক চালক শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করেন দাইমুদ্দিন নামের এক ট্রাক চালক।
দলীয় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দাইমুদ্দিনকে তাড়িয়ে ১৯৮৯ সালের দিকে শ্রমিক ইউনিয়নের দখল নেন নূর হোসেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে হয়ে যান বিএনপি নেতা।
১৯৯২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেনসহ ১৩ জন। তখনকার জনপ্রিয় প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলামকে (নিহত নজরুলের শ্বশুর) পরাজিত করতে নূর হোসেনের পক্ষে মাঠে নামেন সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন।
তার কল্যাণে ভোট জালিয়াতি করে দুই-আড়াইশ ভোটের ব্যবধানে নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি প্রার্থী হিসেবে পরবর্তী ইউপি নির্বাচনেও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয় নূর হোসেন।
তখন আওয়ামী লীগ থেকে শামীম ওসমান প্রার্থী দেন নিহত নজরুল ইসলামকে। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর নূর হোসেনকে টেনে নেয় তৎকালিন এমপি শামীম ওসমান।
গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে পল্টি দিয়ে নূর হোসেন যোগ দেয় শামীম ওসমানের দলে। বনে যান আওয়ামী লীগ নেতা। কিন্ত শামীম ওসমানের হাত ধরে লাইম লাইটে আসা নূর হোসেন ধীরে ধীরে আওয়ামীলীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতা মৃনাল কান্তি দাস, এইচ টি ইমাম, মায়া চৌধুরী ছেলে দীপু চৌধুরী, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের সাথে সখ্য গড়ে তোলেন। তখন শামীম ওসমানকে এড়িয়ে চলতেন নূর হোসেন।
নূর হোসেনের অপকর্ম : বিগত ১৯৯২ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে নুর হোসেন গড়ে তুলে সন্ত্রাসী বাহিনী। তাদের মাধ্যমে পরিবহনে চাদাবাঁজি, জায়গা-জমি দখল, শিল্পকারখানায় চাদাবাঁজি, শীতলক্ষ্যা নদীর তীর দখল করে পাথর বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেন নূর হোসেন। এর আগে (বর্তমান এলডিবির প্রতিষ্ঠাতা) কর্নেল অলি আহমদের গাড়িতে বোমা মেরে আলোচনায় আসেন নূর হোসেন।
১৯৯৬ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে শিমরাইল মোড়ে তার বাহিনীর গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক আলী হোসেন। চাঁদাবাজি, জমি দখল আর হত্যাকান্ডের মাধ্যমে এলাকারবাসীর আতঙ্ক হয়ে উঠেন নূর হোসেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও থেকে যান সব সময় অধরা।
২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। নির্বাচনের দিন ১ আক্টোবর রাতেই স্বপরিবারে পালিয়ে যান ভারতে। তাকে গ্রেফতার করতে ইন্টারপুলে ওয়ারেন্ট জারি করা হয়। পালাতক অবস্থায় শিমরাইলের মনিরকে দিয়ে এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন নূর হোসেন।
কালা শাজাহান, মনির, রাসেল, জুয়েল, ছানা, আলীসহ রয়েছে ২০-২৫ জনের ক্যাডার বাহিনী। নূর হোসেনের ভাই নূরুজামান জজের নেতৃত্বে সোনারগাঁওয়ের আমান, ডেমরার সেলিম, বাতেনসহ ১৫-২০ জনের আলাদা বাহিনী রয়েছে।
এছাড়া তার ভাতিজা কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলের নেতৃত্বে জসিম, লিটন, আসলাম, শামীম, সুরুজসহ দু’ডজন সন্ত্রসী রয়েছে। তখন নূর হোসেনের অবৈধ আয়ের সিহংভাগ উৎসই দখল করে নেয় সে সময়ের বিএনপি থেকে নির্বাচিত স্থানীয় এমপি গিয়াস উদ্দিন।
এক চিঠির জোরে কেটো যায় ইন্টারপোলের ওয়ারেন্ট
প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের লেখা ‘অতি জরুরী’ উল্লেখ করা একটি চিঠি পাল্টে দেয় নূর হোসেনের জীবন।
চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে মেয়র মর্যাদায় পৌরসভার প্রশাসক পদে বসাতে এলজিআরডি মন্ত্রীকে তিনি এ চিঠি দেয়। ২০০৯ সালের ৮ জুন লেখা এ চিঠির জোরে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোর রেড ওয়ারেন্ট থেকে নূর হোসেনের নাম কাটা গিয়েছিল।
চিঠিতে এইচ টি ইমাম নবগঠিত সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভায় নূর হোসেনকে প্রশাসক পদে নিয়োগ দিতে এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ‘বিশেষ অনুরোধ’ জানান।
একটি জায়গায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা হিসেবে উল্লেখ করেন। নূর হোসেন ওরফে হোসেন চেয়ারম্যান ২০০৯ সালের ২০ জুন দেশে ফেরেন।
ইন্টারপোলের ওয়েবপেইজে ২০১০ সালে বলা হয়, ‘সশস্ত্র অপরাধ, হত্যা ও অঙ্গহানিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।’ কিন্তু ২০১৪ সালে নূর হোসেন সম্পর্কে ইন্টারপোলের ওই ওয়েবপেইজে কোনো তথ্যই নেই। জানা যায়, এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ওই একটিমাত্র চিঠি।
চিঠির মূল অংশে এইচ টি ইমাম উল্লেখ করেন, আবেদনকারী (নূর হোসেন) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা। সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাকে অপসারণ করে।
তিনি যাতে আইনের আশ্রয় নিতে না পারেন সে জন্য তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে এইচ টি ইমামের প্যাডে লেখা চিঠিটির অনুলিপি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবকেও পাঠানো হয়।
নূর হোসেনের অবৈধ ব্যবসা : সিদ্ধিরগঞ্জ থানা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার উত্তরে শিমরাইল আন্ত:জেলা ট্রাক টার্মিনাল। পূর্বাঞ্চল থেকে আসা ঢাকামুখী সব মাদক পরিবহনই এই টার্মিনালকে নিরাপদ ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করতো।
প্রতিদিন হাতবদল হওয়া অন্তত ১০ ট্রাকের প্রতিটির বিপরীতে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত (মাদকের ধরন ও দাম অনুপাতে) চাঁদা নিতেন নূর হোসেন।
ট্রাক টার্মিনালে, কাউন্সিলরের অফিসের পিছনে (সাবেক জিহাদ হোটেল), টেকপাড়া, ডেমরা আদমজী রোডে ফজলুর রহমান ও আমিজ উদ্দিন পেট্রোল পাম্পের পিছনে প্রকাশ্যেই বিক্রি হতো ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদ, বিয়ারসহ সব ধরনের মাদক।
এসব মাদক ব্যবসার মালিকানা সরাসরি নূর হোসেনে। যা তদারকি করতেন নূর হোসেনের সহযোগী শাজাহান, সানাউল্লাহ, আজাহার, আলী মোহাম্মদ ও তারসিল।
তার মাদক ব্যবসার বিষয়টি প্রশাসনের সর্বস্তরেই জানা থাকলেও নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে নিরব ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়াও দু’বছর আগেও নুর হোসন শিমরাইল ট্রাক স্ট্যান্ডে অশ্লীল নৃত্যর যাত্রা আর জুয়া চালিয়েছেন।
এসবের রসদ জোগাতে হাতের নাগালে জীবন ধ্বংসকারী সব ধরনের মাদক সরবরাহ করা হয়েছে। বিনিময়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা। প্রশাসনের বড় বাবুরাও এ যাত্রা আসরের দর্শক হয়ে নগ্ন নৃত্য উপভোগ করেছে।
২২ মামলা আসামী হয়ে নূর হোসেন পেল ১১ টি অস্ত্রের লাইসেন্স:
২২ মামলার আসামী হয়ে নূর হোসেন ডিসি এসপির সহায়তায় পেয়েছিলেন ১১ টি অস্ত্রের লাইসেন্স। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২২টি। এরমধ্যে একটি হত্যা মামলাও আছে।
৭ খুনের পর অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল:
৭জনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার প্রধান আসামি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের(নাসিক)কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার অনুসারীদের ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। গত ৫ মে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিয়া অস্ত্রের এ লাইসেন্স বাতিল করেন।
জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
আর্থিক প্রতিদানে নূর হোসেনের শেল্টার দাতা যারা : এলাকায় ফিরে এসেই নূর হোসেন সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ঘড়ে তুলে অর্থিক সম্পর্ক। একইভাবে প্রশাসনের উচ্চমহল থেকে স্থানীয় মহলকেও ম্যানেজ করে চলতেন নূর হোসেন।
শেল্টার দাতাসহ বিভিন্ন মহলে প্রতিমাসে নূর হোসেন টাকার খাম পাঠাতেন। মাসে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মাসোহারা দিতেন তিনি। এ ছাড়াও মাসে ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত মাসোহারা প্রদান করতেন বিভিন্ন মহলকে। সব মহলকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে নূর হোসেন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন।
নিজেকে দানবীর জাহির করতে নূর হোসেন প্রতি রমজান মাসের শেষ তিনদিন গরীব দুস্থ্যদের মাঝে নতুন শাড়ি লুঙ্গি ও অর্থ বিতরণ করতেন।
প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ হাজার নারী- পুরুষকে নতুন কাপড় দিতেন তিনি। দান খাতে ব্যয় করতেন কোটি টাকা। সাধারণ মানুষের সহানুভুতি পেতে এত টাকা খরচ করলেও অপকর্মের কারণে সবই আড়াল হয়ে পড়ে।