বাবা ভরত সিং জয়পুরের একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানায় কাজ করেন। মাসে তাঁর মজুরি ৮ হাজার রুপির মতো। নিজের ছেলে খুব ভালো ক্রিকেট খেলে দেখে কোনো এক বন্ধুর কাছ থেকে ১০ হাজার রুপি ধার করে তাঁকে রাজস্থানের একটি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করেছিলেন চার বছর আগে। সেই ছেলে এই চার বছরে কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে জানেন? নাথু গতকাল আইপিএলে যত টাকায় বিক্রি হয়েছেন, এতগুলো টাকা তাঁর বাবা হয়তো কখনো স্বপ্নেও দেখেননি! দেখার সাহস পাননি।
নাথু নিজেও অতটা ভাবতে পারেননি। নিজের ভিত্তিমূল্য রেখেছিলেন দশ লাখ রুপি। সেটাই নিলামে বাড়তে বাড়তে হয়ে গেল ৩২ গুণ! ৩ কোটি ২০ লাখ রুপিতে (৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা প্রায়) নাথুকে কিনে নিল মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের কথা বলতে পারেন। তবে নাথুর এটি পড়ে পাওয়া নয়। নিজের মেধা আর শ্রম দিয়েই এ পর্যন্ত আসা। তবে তাঁর উত্থানের গল্পটা রূপকথার মতো বৈকি।
ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও নাথুর পদচারণা বেশি দিনের নয়। ভারতের সাংবাদিকেরাই তাঁকে লিখছে ‘অচেনা’ ‘অখ্যাত’। সেই নাথু পারফরম্যান্স দিয়ে তিনি নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছেন, যেখানে টাকার থলে নিয়ে তাঁর পিছু ধাওয়া করার লোকের অভাব হচ্ছে না। এবারের নিলামে এমনই অচেনা-অখ্যাত কয়েকজন ক্রিকেটার চমকে দিয়েছেন। পবন নেগি, ভারতেরই অনেক সমর্থক তাঁর নাম শোনেনি। সেই তিনি নিলামে দামের দিক দিয়ে হারিয়ে দিলেন বেশ কয়েকবার রেকর্ড দামে বিক্রি হওয়া যুবরাজ সিংয়ের মতো ক্রিকেটারকে!
দিল্লি ডেয়ারডেভিলস পবনকে কিনেছে ৮ কোটি ৫০ লাখ রুপিতে, ভারতীয়দের মধ্যে আইপিএলের নিলামে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছেন তিনিই। আরেক ভারতীয় অখ্যাত ক্রিকেটার মুরুগাওন অশ্বিন মাত্র ৩টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ, ২টি লিস্ট ‘এ’ ও ৬টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আইপিএল নিলামে বিক্রি হয়েছেন ৪ কোটি ৫০ লাখ রুপিতে।
তবে এই দুজনের চেয়ে দামে কম পেলেও গল্পটার কারণেই আলোচনায় উঠে এসেছেন নাথু।
গত অক্টোবরে তাঁর রঞ্জি অভিষেক হয় দিল্লির বিপক্ষে। অভিষেকেই অনন্যগতির নিদর্শন ছিল তাঁর বোলিংয়ে। ১৪০ কিলোমিটার বেগে নিয়মিত বল করে সে ম্যাচেই তিনি তুলে নেন দিল্লির ৭ উইকেট। অসাধারণ এই অভিষেকের পর তাঁর দিকে মনোযোগ না ঘুরিয়ে পারেনি ভারতীয় ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তিরা। দিল্লি অধিনায়ক গৌতম গম্ভীর তো আলাদা করেই নাথুর প্রতি মনোযোগ দিতে বলেছিলেন। রাজস্থানের বিপক্ষে সেই ম্যাচে নাথুর গতির অন্যতম শিকার যে ছিলেন তিনিই।
শনিবার আইপিএলের নিলামে ৩৫১ ক্রিকেটারের সঙ্গে তাঁর নামও নিলাম তালিকায় ছিল। সারা ক্রিকেট দুনিয়ার রথী-মহারথীদের সঙ্গে তাঁর নামও আদৌ উঠবে কি না, এ নিয়ে নাথু সংশয়ে ছিলেন। বড় বড় ক্রিকেট তারকাই টেনশন নিয়ে আইপিএলের নিলামের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর নাথু তো তরুণ। টিভিতে সরাসরি নিলাম চলার সময় বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন নাথু। ভয় ছিল, এ নিয়ে উদ্বেগটা হয়তো সামলাতে পারবেন না তাঁর মা। বাবা ভারত সিংও চলে গিয়েছিলেন নিজের কর্মস্থলে। কারখানায়। বন্ধুর বাড়িতে বসে টিভিতে নাথু দেখলেন তাঁর জীবন বদলে দেওয়া সেই মুহূর্তটি।
নাথুকে দলে নেওয়ার জন্য প্রথমে দর ডেকেছিল বেঙ্গালুরু রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স। ভিত্তি মূল্য ১০ লাখ টাকায় ডাকা হয়েছে শুনেই খুশি হয়েছিলেন। ১০ লাখ রুপিও তো তাঁর কাছে অনেক। যেখানে এক সঙ্গে ১ লাখ টাকাও চোখে দেখেননি। কিন্তু এ কী! তাঁকে নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমে গেল বেঙ্গালুরু, দিল্লি ও মুম্বাই। শেষে জয় মুম্বাইয়েরই। জয় আসলে নাথুর জীবনের গল্পটার!
ছেলে এক আইপিএল খেলে ৩ কোটি ২০ লাখ রুপি পাবে শোনার পর ৮ হাজার রুপি বেতন-ভোগী বাবা ভরত একটা কথাই বলছিলেন, ‘ঈশ্বর আছে! ঈশ্বর অবশ্যই আছে!’