কবে থেকে মানুষ প্রথম কথা বলতে শিখেছে তা বলা খুব কঠিন। তবে পুরাতন পাথরের যুগে মানুষ যখন শিকার করা পশুর মাংস আর বুনো ফলমূল খেয়ে বাঁচত, তখন থেকেই যে ভাব বিনিময়ের জন্যে বাধ্য হয়েই সে ভাষা আবিষ্কার করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। প্রথম যখন মানুষের মুখে বুলি ফুটেছিল তার দিন-তারিখ যেমন জানা নেই, তেমনি জানা নেই সেই ভাষা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যও। তবে সময় যেমন থেমে থাকে না, তেমনি থেমে থাকে না ভাষাও। দিনে দিনে পরিবর্তিত হয় ভাষা। ফলে এক ভাষা থেকেই সৃষ্টি হয় বহু ভাষার। দিনে দিনে পুরনো ভাষা থেকে রস-কষ নিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন ভাষার। হাজার হাজার বছরের কালপরিক্রমায় পরিবর্তনের পথ বেয়ে সৃষ্টি হয় ভাষার। আমাদের বাংলা ভাষা সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে প্রায় তিন হাজার বছরের ইতিহাস। এই ভাষায় যারা কথা বলে তারা বাঙালি নামে পরিচিত।
আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল আর্য জাতির লোকেরা। তারা আসার আগে থেকেই উপমহাদেশে বাস করত অন্যান্য জাতির মানুষ। তাদেরকে এখন বলা হয় অনার্য। এই আর্য আর অনার্যদের মধ্যে ছিল অনেক ফারাক। তারা দেখতে যেমন আলাদা ছিল, তেমনি আলাদা ছিল তাদের ভাষাও। তো আর্যরা এসে এখানকার রাজাদেরকে হটিয়ে দিয়ে রাজত্ব কব্জা করল। তাদের ভাষাই হলো সব সরকারি কাজকর্মের ভাষা, অর্থাত্ রাজভাষা। এই ভাষার প্রভাবে স্থানীয় প্রচলিত ভাষাগুলো পরিবর্তিত হতে শুরু করল। স্থানীয় ভাষা আর আর্যভাষা মিলে নতুন ভাষা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হলো। আমাদের বাংলাদেশে আর্যরা আসতে একটু বেশি সময় লেগেছিল। কারণ এই দেশটা আর্যদের প্রথম আগমনের জায়গা অর্থাত্ উত্তর-পশ্চিম ভারত (বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ যার নতুন নাম হয়েছে খাইবার পাখতুন(খায়া) থেকে অনেক দূরে। তো আর্যদের প্রভাব বাড়ার সাথে সাথে তাদের ভাষার প্রভাবও এখানে বাড়তে লাগল।
আর্যভাষার লিপি ব্যবহার করে লেখালেখিও শুরু হলো। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আদি ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন ছিল। এটি থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ অব্দের কাছাকাছি সময়ের অশোক লিপির সৃষ্টি হয়েছিল। তা থেকে ১০০ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কুশান লিপি, ৪০০ থেকে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্ত রাজাদের আমলের গুপ্ত লিপি, ৬০০ থেকে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকের বেশ জটিল ধরনের 'কুটিল লিপি' এবং ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রাচীন বাংলা লিপির সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদও প্রায় হাজার বছরের পুরনো। অর্থাত্ অনেক পরিবর্তনের পথ বেয়ে প্রায় হাজার বছর আগে বাংলাভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। এই ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা আছে। পৃথিবীর বহু ভাষারই নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তারা অন্য ভাষার বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখে। এটি বাঙালির জন্য এক বিশেষ গৌরবের বিষয়। তবে বাংলা ভাষার ওপর যেমন আক্রমণ এসেছে, তেমনি আক্রমণ এসেছে বাংলা বর্ণমালার ওপরেও। বাঙালি ভাষা আন্দোলন করে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা এনে দিয়েছে। সেই প্রথম বাংলা কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হলো। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলা ভাষা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো দেশের একক জাতীয় ভাষার মর্যাদা পেল।
পাকিস্তানী শাসকরা বাংলা ভাষার সর্বনাশের জন্যে বাংলা বর্ণমালা তুলে দিয়ে এই ভাষা লেখার জন্য আরবি বা রোমান হরফ চালুর চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু সতর্ক বাঙালি তা রুখে দিয়েছে। তবে এখনও সতর্ক থাকতে হবে, যাতে বাংলা ভাষার মর্যাদা ভবিষ্যতেও কেউ কখনও ক্ষুণ্ন করতে না পারে।
Collect from -The Daily Ittefaq