হঠাৎ করে আমাদের বুকে ব্যথা হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই ব্যথা কখনো কম হয় আবার এই কম ব্যথাই জটিল হয়। আজ ৭ জুন এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২০৫৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কার্ডিওলজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও অধ্যাপক ডা. এম এ রশিদ
প্রশ্ন : বুকের ব্যথার সাধারণ কারণ থেকে জটিল কারণগুলো কী কী?
উত্তর : বুকের ব্যথা আসলে একটি লক্ষণ। অনেক কারণে বুকের ব্যথা হতে পারে। বুকের ভেতরে যতগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে, প্রতিটিই বুকের ব্যথা তৈরি করতে পারে। আবার বুকের ব্যথা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। যেমন পেটের কোনো কারণে বুকের ব্যথা হতে পারে। মাথার কোনো কারণে বুকে অস্বস্তি হতে পারে। তবে বুকের ভেতরে যে ব্যথাটা, একটা মধ্যবয়সী বা প্রাপ্তবয়স্ক লোকের হাঁটাচলা করার সময় যদি বুকের ব্যথা হয়, তখন এর গুরুত্ব অনেক।
এফোর্ড এনজাইনা বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়। অর্থাৎ কাজ করার সঙ্গে যদি ব্যথাটা হয়, আবার বিশ্রাম নিলে কমে যায়, এ রকম অবস্থা হলে এটি বেশ সমস্যার। এ রকম অবস্থায় সাধারণত রক্তনালিতে অর্থাৎ করনারি আর্টারিগুলো সংকচিত হয়ে আসতে পারে বা ব্লক তৈরি হতে পারে। এ রকম অবস্থা যদি হয় বুকে ব্যথা বা বুকে চাপ বা বুকটা ভারি লাগে, সেটা বাম পাশে বা ডান পাশে হোক বা মাঝখানে হোক যেকোনো জায়গায় হতে পারে। এ রকম অবস্থায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তখন ধরে নেওয়া যায় যে ব্যথাটা হয়তো হৃদরোগের কারণে হতে পারে।
প্রশ্ন : আর কী কী কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে?
উত্তর : বুকের যে হাড় আছে, পেশি আছে এগুলোর কারণে হতে পারে। আবার হার্টের গায়ে যে পর্দা আছে, এর কারণেও হতে পারে। বা ফুসফুসের গায়ের ওপরে যে পর্দা আছে, এগুলোর অসুবিধাতেও বুকের ব্যথা হতে পারে। এমনকি গ্যাসট্রিকের সমস্যা হলেও কখনো কখনো বুকে ব্যথা হতে পারে।
প্রশ্ন : অনেকেই বুকে ব্যথা হলে আতঙ্কিত বোধ করেন হাসপাতালে যেতে হবে কি হবে না এই বিষয়ে। তখন আবার অনেকে দ্বিধান্বিত থাকেন এটা গ্যাসট্রিকের জন্য হয়েছে নাকি হার্টের সমস্যার কারণে হয়েছে বিষয়টি নিয়ে। তখন গ্যাসট্রিকের ওষুধ খান। এই দুটো ব্যথাকে পার্থক্য করার বা বোঝার কি কোনো উপায় রয়েছে?
উত্তর : ধরুন, খাবার পরে তার বুকে ব্যথা হলো এবং তার বয়স যদি ৩০-এর ঊর্ধ্বে হয় এবং সে যদি ধূমপান করে, তার যদি ডায়াবেটিস থাকে, তার যদি উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তার পরিবারের এ ধরনের ইতিহাস থাকে-এ ধরনের একটা মানুষের যদি বুকে ব্যথা করে, এ রকম অবস্থা হলে, অবশ্যই তাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঙ্গে সঙ্গে তাকে জরুরি বিভাগে নেওয়া উচিত এবং যেই ধরনের চিকিৎসকরা বোঝে এই সমস্যাগুলো তাদের কাছে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
প্রশ্ন : হার্টের কারণে ব্যথা হচ্ছে যদি কোনো রোগী বুঝতে পারে তবে কি চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে কোনো বিষয় আছে?
উত্তর : যদি কাজের সাথে ব্যথার সম্পর্ক থাকে অর্থাৎ পরিশ্রম করলে যদি বেড়ে যায়। তখন অনেকে ধন্দে পড়ে যায়, ভাবে ব্যথাটা হয়তো গ্যাসের হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে নিজে নিজে ওষুধ না খেয়ে এবং অবশ্যই সময় নষ্ট না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। সেই ক্ষেত্রে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগটি নিশ্চিত হতে হবে। আর যদি নিজে নিজে বাড়িতে বসে চিকিৎসা করে, এতে সময় নষ্ট হয় এবং সমস্যাটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন দেখা যায়, চিকিৎসা করাই কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : যদি কেউ বোঝে যে হার্টের কারণে ব্যথাটি হচ্ছে সেই ক্ষেত্রে কি এসপিরিন-জাতীয় ওষুধ খেতে পারবে?
উত্তর : যদি সে বিষয়টি বোঝে বা আগে থেকে সে জানে তার কার্ডিয়াক সমস্যা আছে। তবে সেই ক্ষেত্রে এসপিরিন বা ডিসপিরিন-জাতীয় ওষুধ ৩০০ মিলিগ্রাম খেতে পারে।
আরেকটি স্প্রে আছে নাইটোগ্লিসারিন নামে, ওই রকম অবস্থায় জিহ্বাটা উঁচু করে মুখের ভেতর স্প্রে করতে পারে। বসা অবস্থায় স্প্রে করা উচিত। দাঁড়িয়ে করলে সে পড়ে যেতে পারে। কারণ এটা অনেক সময় রক্তচাপ কমিয়ে দেয়। তবে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন : আপনাদের কাছে যাওয়ার পর আপনারা কীভাবে নির্ধারণ করেন এটা কতটা গুরুতর, কোন অবস্থায় আছে এবং এর জন্য করণীয় কী?
উত্তর : চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার খুব দ্রুত একটা পরীক্ষা করা হয়। এই ব্যথাটা কখন শুরু হলো, কী ধরনের ব্যথা, ইতিহাস শুনলেই বোঝা যাবে এটা কোন ধরনের ব্যথা। এরপর একটা ইসিজি করা হয় এবং ট্রপোনিন পরীক্ষা করা হয়। সঙ্গে রক্তে শর্করার পরীক্ষা করা হয়।
আবার বুকে ব্যথা হয়েই যে সঙ্গে সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়, বিষয়টি সেটা নয়। এটা একটা উপসর্গ। যখন সমস্যাটা শুরু হয়, তখনই বুকে ব্যথা-জাতীয় উপসর্গ আসে। আর যদি গুরুতর ব্যথা হয় এবং সেই ব্যথা যদি কিছুতেই না কমে, তখন মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং তখন ধরে নিতে হবে হার্টঅ্যাটাক হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : চিকিৎসার বিষয়ে আপনারা কী করে থাকেন?
উত্তর : এটাকে আমরা দুই ভাগে বিভাজন করি। একটিকে স্ট্যাবল এনজাইনা বলি। আরেকটিকে আনস্ট্যাবল এনজাইনা বলি। স্ট্যাবল বলতে বোঝায় সাধারণ পরিশ্রম করলে ব্যথাগুলো হয়। আবার বিশ্রাম নিলে কমে যায়। এ সমস্যার চিকিৎসায় রোগী যদি চিকিৎসকের কাছে যায় প্রথম একটি ইসিজি করা হয়, তার সাধারণ কিছু রক্ত পরীক্ষা করা হয়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা দেখা হয়, রক্তে শর্করা আছে কি না দেখা হয়, পরবর্তীকালে একটা ইকোকার্ডিওগ্রাম করা হয়। স্বাভাবিক থাকলে ইটিটি করা হয়। এখানে যদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি রোগীটা ঠিক আছে।
আর যদি সমস্যা থাকে তবে ইটিটিতে অবশ্যই দেখা যায় কিছু পরিবর্তন আসে। তার পরবর্তী টেস্ট হচ্ছে এনজিওগ্রাম বা করনারি সিটি এনজিওগ্রাম। তখন যেখতে হবে রক্তনালিতে কতগুলো ব্লক আছে। সেই অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
প্রশ্ন : একবার যদি কেউ হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত হয়, পরবর্তী সময়ে কি তার হার্টঅ্যাটাকের ঝুঁকি কম না বেশি?
উত্তর : যার একবার অ্যাটাক হয়েছে, তার আবার হওয়ার আশঙ্কা অনেক। কারণ তার সমস্যাটা রয়ে গেছে। তখন তার জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হবে। নিয়মিত ফলোআপ এসব তার জন্য খুবই জরুরি।